আশিকুল ইসলাম মিথুন,চৌগাছা(যশোর) প্রতিনিধিঃ
যশোরের চৌগাছায় সপ্তাহব্যাপী শতাব্দীকালের ঐতিহ্যবাহী বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা শুরু হয়েছে।মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে এ মেলা শুরু হয়। করোনার কারণে গত ২ বছর মেলা না হলেও এবছর জমজমাট মেলা বসেছে। মেলায় আগতদের নিরাপত্তায় পরিচালনা কমিটি গঠনসহ নানা ধরণের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ভারতীয় সীমান্তর্তী যশোরের চৌগাছা উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের ধারে একটি উঁচুস্থানে পীরে কামেল বলুহ দেওয়ান (রহ.) এর রওজা শরীফ অবস্থিত। এ রওজা শরীফকে কেন্দ্র করে প্রতি বাংলা সালের ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা বসে।এখানকার তিন কিলোমিটার রাস্তার পাশে কাঠ-স্টিলের খাট-পালঙ্ক এবং আসবাবপত্র, খেলনা, কসমেটিকস, মিষ্টি-মিঠাই, পোশাক, গহনা, ইলেকট্রনিকস দ্রব্যাদি, বইপত্র, বিভিন্ন শৌখিন জিনিসসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুর স্টল বসে।
প্রতিবছর মেলা চলাকালে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে,স্থানীয়দের বিশ্বাস, চৌগাছার যাত্রাপুর গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ছেলে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, বলুহ দেওয়ানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সুদূর অতীতকাল থেকে হাজরাখানায় প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা বসে আসছে। আগেকার দিনে মেলার সঙ্গে আয়োজন করা হতো ধর্মসভার। এ সভায় ফুরফুরা ও শর্ষিনাসহ বিভিন্ন স্থানের খ্যাতনামা পীর সাহেবরা অংশ নিতেন। কিন্তু ওই ধর্মসভা এখন আর হয় না। তবে মেলার আগে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এলাকায় জনশ্রুতি আছে, পীর বলুহ দেওয়ান যা বলতেন তাই হতো। ’ তার জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল রহস্যে ঘেরা। তবে জন্মকাল সম্পর্কে আজও কোনো সঠিক তথ্য না মিললে জেষ্ঠ্য ভক্তদের মতে ‘ তিনি প্রায় দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।
বলুহ দেওয়ান (রহ) মৃত্যুর পর এ অঞ্চলের তৎকালীন জমিদার কে.টি চৌধুরী তার রওজা এলাকায় সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য ১৫ শতাংশ জমি দান করেন।
পীর বলুহ দেওয়ান সম্পর্কে এলাকায় আরো জনশ্রুতি রয়েছে, তার বয়স ১০/১২ বছর তখন পিতার আদেশে গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন। গরু দিয়ে ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগে ক্ষেত মালিক গরুগুলো ধরতে গেলে তিনি সব গরু বক বানিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখেন।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের জমিতে দিনমজুরির কাজ করতেন। একদিন সরিষা মাড়াই করতে মাঠে গিয়ে সরিষার গাঁদায় আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদ শুনে গৃহস্থ মাঠে গিয়ে দেখে সরিষার গাঁদায় আগুন জ্বলছে, এতে গৃহস্থ রাগান্বিত হলে তিনি হাঁসতে হাঁসতে ছাই উড়িয়ে দেখিয়ে দেন সরিষা পুড়েনি।
এলাকায় আরও জনশ্রুতি আছে, পীর বলুহ দেওয়ানের মামী তাকে খেঁজুর রসের চুলায় জ্বাল দিতে বললে তিনি জ্বালানির পরিবর্তে চুলায় পা ঢুকিয়ে আগুন জ্বাল দিতে থাকেন। এতে তার পায়ের কোনো ক্ষতি হয়নি।
এ ধরণের একাধিক অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিতে থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ তার নিকট এসে শিষ্যত্ব নেন। ‘অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর আখ্যা পান। ’ তার মৃত্যুর পর গ্রামাঞ্চলের মানুষ জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে তার নামে মানত করতে থাকে এবং প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হাজরাখান গ্রামে অবস্থিত তার রওজা শরীফে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, নারকেল ও টাকাসহ নানা দ্রব্যাদি ও টাকা দিয়ে মানত শোধ করতে থাকেন। সেখান থেকেই একসময় এখানে আসা ভক্তদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য গড়ে ওঠে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা। দীর্ঘদিন থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা হতে থাকলেও বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলছে জমজমাট মেলা।