নিউজ ডেস্ক :
শহরের পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট স্কুল। বেশিরভাগই ভাড়া ভবনে। এগুলো কিন্ডারগার্টেন বা কেজি স্কুল। তবে প্রি-ক্যাডেট বা প্রিপারেটরি স্কুল নামও জুড়ে দিয়েছে কেউ কেউ। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, চটকদার নাম থাকলেও এগুলোর শিক্ষার মান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আশানুরূপ নয়। নেই মানসম্মত শিক্ষক। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে গড়ে ওঠায় বহু প্রতিষ্ঠানেই নেই শিক্ষার পরিবেশ। কোনো কোনো স্কুলে জাতীয় শিক্ষাক্রমের বাইরে মানহীন বইও পড়ানো হয়। শিক্ষকদের বেতন খুবই সামান্য। শিক্ষক নিয়োগেও নেই যোগ্যতার বালাই। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ারও কেউ নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কিন্ডারগার্টেনগুলোর নিবন্ধন দিলেও কেবল বিনামূল্যের পাঠ্যবই দেওয়া ছাড়া এসব স্কুলের কোনো দায়-দায়িত্ব নেয় না। ফলে হাতেখড়িতেই মানহীন শিক্ষার কবলে পড়ছে লাখ লাখ শিশু। কিন্ডারগার্টেন পরিচালনাকারী ব্যক্তিরাই একে হযবরল অবস্থা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তাঁরা বলছেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন তাঁরা। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর সবই গড়ে উঠেছে স্বল্পপুঁজিতে ভর করে। করোনাকালের দুই বছরে পুঁজি হারিয়ে তাঁরা পথে বসেছেন।
তাঁদের হিসাবে, সারাদেশের অন্তত ১০ হাজার কিন্ডারগার্টেন এ সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে। যাঁরা কোনো মতে টিকে আছেন, তাঁরা বিপুল শিক্ষার্থী হারিয়েছেন। বাড়ি ভাড়া জমে বিপুল অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। এসব নিয়ে প্রতিনিয়তই বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে আগের জায়গা ছেড়ে দিয়ে স্বল্প পরিসরে স্কুল চালাচ্ছেন।
কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের দেওয়া তথ্যমতে, সারাদেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ৬০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ আর শিক্ষার্থী ১ কোটি। এই সেক্টরটি পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। আর এর সম্পূর্ণটাই শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর নির্ভরশীল।
এসব প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে থাকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ২০১১ সালের একটি নীতিমালার ভিত্তিতে এসব বিদ্যালয়কে নিবন্ধন দেওয়া হয়। নিবন্ধন পেলে প্রতিষ্ঠানগুলো একটি কোড নম্বর পায়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্নিষ্টরা জানেন না, সারাদেশে নিবন্ধিত স্কুলের সংখ্যা কত। আবার নিবন্ধনবিহীনও বহু স্কুলও দিব্যি চলছে।
দেশের বেশ কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকরা জানান, আড়াই হাজার থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে বেতন পান। তাঁরা কোনো নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে এ পেশায় আসেননি। এ পেশায় আসার পরও কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ পাননি। বেশ কিছু স্কুলে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠাতা নিজেই অধ্যক্ষ। তাঁর স্ত্রী ও স্বজনরা শিক্ষক।
আগামী জানুয়ারি থেকে সারাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এই শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতিও ভিন্ন। চলতি মাসেই সারাদেশের শিক্ষকদের এই শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ দিতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রমে ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অথচ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা তাতে অন্তর্ভুক্ত নেই।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের নতুন কারিকুলামে প্রশিক্ষণের কী হবে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেবে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা জানান, তাঁদের কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। মুখের কথায় চাকরি হয় আবার সেভাবেই চলে যায়।
অনেক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন কিন্ডারগার্টেন গুলো অপ্রয়োজনীয় বই পড়ায়। এটা শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, এই বিশাল সেক্টরটি করোনা মহামারির কারণে খুবই দূরবস্থার মধ্যে পড়েছিল। এটা এখনও বিদ্যমান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯৯ ভাগই ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারের সব নির্দেশনা মেনেই পরিচালিত হয়। কিন্ডারগার্টেনগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বেকারত্ব নিরসনেও বিরাট ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, আমরা ১ কোটি শিক্ষার্থীকে পাঠদান করে থাকি। তাদের শিক্ষার মান ও ফলাফল সরকারি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক গুণ বেশি ভালো, যা শতভাগ প্রমাণিত। আমাদের এ প্রতিষ্ঠানগুলো না থাকলে এই ১ কোটি শিক্ষার্থীর বাধ্যতামূলকভাবে পাঠদান সরকারকেই করাতে হতো। এতে তাদের জন্য অবকাঠামো, ফার্নিচার ও অন্যান্য সব সুবিধাসহ অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে হতো। তাছাড়া তাঁদের প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হতো। এতে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হতো।
নিজেদের সংকটের কথা তুলে ধরে ইকবাল বাহার বলেন, করোনা মহামারিতে সরকারি নির্দেশে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তখন তাঁরা বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিলসহ যাবতীয় ইউটিলিটি, টিচার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে না পেরে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন। বাড়িভাড়া দিতে না পারায় হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, হাজার হাজার শিক্ষক চাকরি হারিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। দুর্ভাগ্যবশত এতকিছুর পরও সরকারের টনক নড়েনি। তাদের একটি টাকা দিয়েও সহায়তা করেনি বরং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও ডিজি বিভিন্ন সময় বলেছেন, কিন্ডারগার্টেনের দায়দায়িত্ব তাঁদের নয়।
তিনি বলেন, নতুন একটি বিদ্যালয় নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে বছরের পর বছর পড়ে থাকে। এটি নিয়ে হয়রানির শেষ থাকে না উদ্যোক্তাদের। কখনও কখনও সারাদেশ থেকে আসা ফাইল অধিদপ্তরে এসে গায়েব হয়ে যায় এবং অধিকাংশ ফাইল মিটিংয়ে ওঠে না।
Leave a Reply