সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক, বেরোবি:
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল কর্তৃক জুলাই বিপ্লবের উপর তৈরি করা ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টের বিতরণ ও আলোচনা বিষয়ক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সেমিনারটি কেবল সেই ভয়াবহ দিনগুলোর নির্মম সত্য উন্মোচন করেনি, বরং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক দৃঢ় অঙ্গীকারের জন্ম দিয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সমগ্র সচেতন সমাজে অনুরণিত হয়েছে।
১৫ মে, ২০২৫ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের গ্যালারি রুমে আয়োজিত এই সেমিনারটি জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটরস অফিস (ইউএনআরসিও)-এর সক্রিয় সহায়তায় এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর নিবেদিত তত্ত্বাবধানে সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এই আয়োজনটি শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, বরং এটি ছিল সেইসব মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতির প্রকাশ, যারা জুলাইয়ের অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: শওকাত আলী। তার উপস্থিতি এবং মূল্যবান বক্তব্য সেমিনারের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ অতিথি হিসেবে মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করেন জাতিসংঘের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান। তার বিশ্লেষণাত্মক বক্তব্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রেক্ষাপটে জুলাইয়ের ঘটনার তাৎপর্য তুলে ধরে। এছাড়াও, অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্র পরামর্শ ও উপদেষ্টা পরিচালক প্রফেসর ড. ইলিয়াস প্রামাণিক, যিনি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন; সহকারী প্রক্টর ড. আবদুল্লাহ আল মাহাবুব, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত; শহীদ ফেলানী হলের প্রভোস্ট ড. সিফাত রুমানা এবং মানবাধিকার সহায়তা সোসাইটির নিবেদিত নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম, যিনি ভুক্তভোগীদের আইনি ও মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। সেই কালো রাতে স্বজন হারানো নিহতদের পরিবারের সদস্যরা এবং যারা সেদিন আহত হয়েছেন, সেই সাহসী যোদ্ধারাও তাদের হৃদয়স্পর্শী অভিজ্ঞতা সকলের সামনে তুলে ধরেন, যা উপস্থিত সকলের হৃদয় নাড়া দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সেমিনারে অংশগ্রহণ করে এবং জুলাইয়ের মর্মান্তিক ঘটনা ও জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টের উপর তাদের গভীর অনুভূতি ও সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করে। তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে, তরুণ প্রজন্ম মানবাধিকারের প্রশ্নে কতটা সংবেদনশীল।
সেমিনারের গভীরে:
এই সেমিনারের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিক জনসাধারণের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং এর সুপারিশগুলো নিয়ে একটি গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ আলোচনা করা। জুলাই মাসে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও এর সংলগ্ন এলাকায় সংঘটিত অপ্রত্যাশিত ও বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর একটি নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ তদন্তের ফসল এই রিপোর্টটি। রিপোর্টের প্রতিটি তথ্য অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যাতে কোনো প্রকার ভুল বা অতিরঞ্জন না থাকে।
রিপোর্টটিতে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে:
• শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর আকস্মিক ও নির্বিচারে চালানো দমন-পীড়ন এবং এর ফলস্বরূপ বহু মূল্যবান জীবনের অপচয় ও অসংখ্য মানুষের গুরুতর আহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা।
• সেদিন যারা অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হয়েছেন এবং বন্দি অবস্থায় অকথ্য ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা ও বস্তুনিষ্ঠ সাক্ষ্যপ্রমাণ, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
• ঘটনার সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহে কী ধরনের অগণতান্ত্রিক বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা জনগণের জানার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে।
• মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান দীর্ঘসূত্রিতা ও প্রতিবন্ধকতা, যা আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।
• ভবিষ্যতে এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে জরুরি, কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা, যাতে আর কোনো নিরপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন না হয়।
বক্তাদের হৃদয়স্পর্শী ভাষ্য:
• শহীদ আবদুল্লাহ আল তাহিরের মায়ের গভীর আর্তি: শহীদ আবদুল্লাহ আল তাহিরের শোকাহত মা তার নয়নের মণি পুত্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার প্রতিটি শব্দে ঝরে পড়ে গভীর বেদনা ও অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি বলেন, "আমার তাহের ছিল এক অমায়িক, শান্ত ও মেধাবী ছেলে। তার মিষ্টি ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তার সহপাঠীরা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে আনন্দ করত। আজ আমার সেই আদরের ধন আর নেই। আমি শুধু চাই, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টে আমার ছেলের যে আত্মত্যাগের কথা ন্যায়সঙ্গতভাবে লেখা হয়েছে, তার যেন সঠিক ও দ্রুত বিচার হয়। যারা আমার কলিজার টুকরাকে কেড়ে নিয়েছে, আমি তাদের কঠোরতম শাস্তি দেখতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের কোল খালি না হয়।"
• উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: শওকাত আলীর দৃঢ় অঙ্গীকার: বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: শওকাত আলী তার বক্তব্যে বলেন, "বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা ন্যায়নীতি, মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তার এক অটল স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা এমন একটি উদার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী তাদের সৃজনশীলতা ও মতামত দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করতে পারবে। জুলাই মাসের সেই কালো রাতে আমরা আমাদের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদকে অন্যায়ভাবে হারিয়েছি। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টে এই মর্মান্তিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়ে