সোহেল রানা,রাজশাহী,প্রতিনিধি:
বেশ কয়েকদিন ধরে রাজশাহী, বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলের হিমাগার ফটকে আলুর অস্বাভাবিক দরপতন অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকা তো কোথাও ১০ টাকা। খুব উন্নতমানের আলু সর্বোচ্চ ১১ থেকে ১২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। এ কারণে হিমাগারগুলোর সামনে আলুচাষিদের আহাজারি চলছে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব লাখো চাষি। অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা লিখছেন-‘আর করব না আলু চাষ, দেখব তোরা কী খাস।’ তাদের এই খেদোক্তি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে।বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় ২৭ আগস্ট হিমাগার ফটকে আলুর কেজি সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ হাজার টন ক্রয়ের প্রজ্ঞাপন জারি করলেও সোমবার পর্যন্ত তা কার্যকরের কোনো নির্দেশনা মাঠ প্রশাসনে পৌঁছায়নি। এমনকি প্রজ্ঞাপনের কপি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক অথবা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কোথাও পাঠানো হয়নি। রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) খোন্দকার আজিম আহমেদ ওইদিন সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয় ঘোষিত আলুর সর্বনিম্ন মূল্য কার্যকর সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশনা তার অথবা অধীনস্ত কোনো জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পৌঁছায়নি। ফলে এ বিষয়ে তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি।সোমবার রাজশাহীর পবা, মোহনপুর ও তানোরের কয়েকটি হিমাগার ঘুরে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মার্চে আলু আহরণের সময় কেজিতে দাম ছিল ১৪ থেকে ১৫ টাকা। তারা বেশি দামের আশায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হবে ভাবতে পারেননি। গত কয়েকদিন ধরে হিমাগার ফটকে আলু বিক্রি হচ্ছে কেজি ৮ থেকে ১০ টাকা। প্রতি কেজিতে লোকসান হচ্ছে ১৫ টাকা। হিমাগার ভাড়া ও শ্রমিক খরচ মিটিয়ে অনেক চাষি শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছেন। চাষিদের চরম এই দুর্দশার চিত্র রাজশাহী, বগুড়া ও রংপুরসহ উত্তরের সর্বত্র। অনেক চাষি ক্ষোভে হিমাগার থেকে আলু বের না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ এত কম দামে আলু বিক্রি করে হিমাগার ভাড়া ও শ্রমিক খরচ মিটিয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।রাজশাহীর তানোরের লালপুর গ্রামের আলুচাষি শরিফুল ইসলাম জানান, ২৫ সেপ্টেম্বর রহমান কোল্ড স্টোরেজে রাখা ১০০ বস্তা (প্রতি বস্তায় ৬০ কেজি) সমান ৬ হাজার কেজি আলু বিক্রির পর হিমাগার ভাড়া ও শ্রমিক খরচ মিটিয়ে হাতে পেয়েছেন মাত্র ১৯ হাজার টাকা। প্রতি কেজি আলু ফলাতে তার খরচ হয়েছে ২২ টাকা। এর সঙ্গে দুই টাকা শ্রমিক ও পরিবহণ ভাড়া এবং হিমাগারে সংরক্ষণ খরচ ৬ টাকা যোগ করে মোট উৎপাদন খরচ পড়েছে ৩০ টাকা। খরচ মিটিয়ে ৬ হাজার কেজি আলু বিক্রি করে পেলেন মাত্র ১৯ হাজার টাকা। গত বছর একই সময়ে ১০০ বস্তা আলু বিক্রি করে পেয়েছিলেন ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার তার নিট লোকসান হলো ২ লাখ ২১ হাজার টাকা। আরও ১০০ বস্তা আলু হিমাগারে আছে। তুলবেন কিনা সেটাই ভাবছেন।
রহমান কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম জানান, মানভেদে এদিন প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা। এর মধ্যে অর্ধেকেই খরচ হয়ে যাচ্ছে হিমাগার ভাড়া ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ। খরচ মিটিয়ে চাষিরা পাচ্ছেন মাত্র ৪ থেকে ৫ টাকা। আলু নিয়ে চাষিদের এমন বিপর্যস্ত অবস্থা অতীতে কখনো ঘটেনি। সরকার মাস খানেক আগে হিমাগার গেটে আলুর সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও এ বিষয়ে প্রশাসন বা কৃষি বিভাগ থেকে তাদের এখনো কোনো কিছু বলা হয়নি।রাজশাহীর যমুনা কোল্ড স্টোরেজের সামনে সোমবার সকালে কথা হয় চাষি শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। এই হিমাগারে তিনি ৩৫০ বস্তা আলু রেখেছিলেন। ৮ সেপ্টেম্বর ১৫০ বস্তা বিক্রি করেন ১৩ টাকা কেজি দরে। ২৩ সেপ্টেম্বর ৫০ বস্তা বিক্রি করেন ১২ টাকা কেজি করে। সোমবার ১০০ বস্তা বিক্রি করেন ১১ টাকা কেজি দরে। এনজিও থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ করে আলু চাষ করেছিলেন তিনি। নিজের পুঁজি ছিল আরও সাড়ে তিন লাখ। এবার সব মিলিয়ে লোকসান দাঁড়াবে ৫ লাখের বেশি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আর আলু চাষ করব না। এ দেশে কৃষককে দেখার কেউ নেই।’বগুড়ার আদমদীঘির আলু চাষি আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে। তিনি জানান, আলুর দাম আর জানতে চেয়ে কি হবে। আমরা কৃষকেরা এবার প্রতারিত হয়েছি। সরকার ২২ টাকা সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণের কথা জানানোর পর আমরা ভাবছিলাম আলুর দাম হয়তো কিছুটা বাড়বে। ২৭ আগস্ট সরকার ফলাও করে এটা প্রচার করেছিল। ওই সময় হিমাগার ফটকে আলুর দাম ছিল ১৩ থেকে ১৪ টাকা। শনিবার আমি ২৫০ বস্তা বিক্রি করেছি ১১ টাকা করে। তখন বিক্রি করলেও হয়তো আরও কিছু টাকা পেতাম। এবার বগুড়ার শত শত চাষি পুঁজি হারিয়ে পথে বসে যাবে।আলুর সর্বনিম্ন সরকারি মূল্য ২২ টাকা বগুড়ায় কার্যকরের বিষয়ে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক (যুগ্ম-সচিব) হোসনা আফরোজা যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটা প্রজ্ঞাপন আমরা পেলেও এটা কীভাবে কার্যকর করা হবে সে সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশনা তাতে নেই। ফলে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। সরকারি ভাবে আলু কেনার বিষয়েও বিশেষ কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।’এদিকে রংপুর অঞ্চলেও আলুর অস্বাভাবিক মূল্য পতনে চাষিরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ অঞ্চলের বিভিন্ন হিমাগার ফটকে প্রতি কেজি ৮ থেকে ৯ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে রংপুর কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্তপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘গত মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে আলু উৎপাদন অনেক বেশি ছিল। বাজারে আলু উদ্বৃত্ত। সরকার ২২ টাকা কেজি সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করলেও এটা মাঠপর্যায়ে কীভাবে কার্যকর করা হবে সে বিষয়ে বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই।’কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, গত মৌসুমে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়। প্রতি হেক্টরে ২৭ টন হিসাবে এই পরিমাণ জমি থেকে এবার প্রায় মোট ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার টন আলুর ফলন হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে আলু সংরক্ষণের জন্য ২২১টি হিমাগার রয়েছে। আলু বিক্রির মৌসুম শেষ হতে চললেও এখনো হিমাগারগুলোতে অর্ধেক আলু সংরক্ষিত আছে। ডিসেম্বরে আগাম জাতের নতুন আলু বাজারে আসবে। এত বিপুল পরিমাণ আলুর কী হবে কেউ জানেন না।
Leave a Reply