সোহেল রানা,রাজশাহী প্রতিনিধি:
রাজশাহীর খাদ্য বিভাগের দুটি গুদামে খাওয়ার অনুপযোগী চাল পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবারও জেলার দুর্গাপুর উপজেলার খাদ্যগুদাম থেকে ২০ টান নিম্নমানের চাল বের হয়েছে। এ নিয়ে ওই গুদাম থেকে এ পর্যন্ত এ ধরনের ৮০ মেট্রিক টন চাল বের হলো।
নিম্নমানের চাল উদ্ধারের ঘটনায় এরই মধ্যে বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দুর্গাপুর উপজেলা খাদ্যগুদামের কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এই দুটি ঘটনার পাশাপাশি জেলার অন্য উপজেলার খাদ্যগুদামগুলোর অবস্থা খতিয়ে দেখতে মোট আটটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা খাদ্য বিভাগ। অবশ্য ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। এই নিয়ে জেলার খাদ্য বিভাগে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ ধান কিনে চালকলের মালিকদের (মিলার) দেবে। তাঁরা ধান ভাঙিয়ে চাল করে দেবেন। এরপর সরবরাহ করা চালের বস্তার গায়ে খাদ্যগুদামের সিল দেওয়া হয়। গুদামের অনেক বস্তাতেই সেই সিল পাওয়া যাচ্ছে না।এ ব্যাপারে রাজশাহী আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাইন উদ্দিন বলেন, এগুলোও অনিয়মের মধ্যে পড়ে। তদন্ত কমিটি এগুলোও দেখবে। অনিয়ম পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁরা কয়েক দিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন পাবেন।চাল সংগ্রহে নীতিমালা মানা হয়নিভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. বাচ্চু মিয়ার বরখাস্তের আদেশ ৭ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘তিনি গুদামে সংরক্ষিত ভালো মানের চাল উদেশ্যপ্রণোদিতাবে পরিবর্তন করে অসৎ উদ্দেশ্যে নিম্নমানের চাল খামাল অভ্যন্তরে সুকৌশলে মজুত করেছেন।’ তবে ঠিক কী পরিমাণ নিম্নমানের চাল পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে জানা যায়নি।নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, চলতি মৌসুমে বাগমারার তিনটি চালকল চুক্তি করেছিল। সেগুলো হলো কনক চালকল, আরাফাত চালকল ও ভাই ভাই চালকল। এসব চালকল থেকে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার তানোরের আবদুস সাত্তার চালকল, হড়গ্রামের বাদশা রাইস মিল, মোহনপুরের নুরজাহান চালকল, মাহফুজ চালকল ও মোল্লা চালকল থেকে ধান ছাঁটাই করে চাল এই গুদামে আনা হয়েছে। আটটি চালকল থেকে ১ হাজার ২১১ মেট্রিক টন চাল আনা হয়েছে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে।গুদামে নিম্নমানের চাল পাওয়া প্রসঙ্গে বাগমারার চুক্তিবদ্ধ তিন চালকলমালিক নজরুল ইসলাম, ইয়াছিন আলী ও শামসুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁরা ভালো চাল দিয়েছেন। বাগমারার বাইরে থেকে নিম্নমানের চাল এসেছে।খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্যগুদামে সাধারণত পরিদর্শক ছাড়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় না। মো. বাচ্চু মিয়া উপপরিদর্শক হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা খাদ্যগুদামের উপপরিদর্শক হিসেবে তিনি বদলি আদেশপ্রাপ্ত ছিলেন। তবে তাঁকে সংযুক্তিতে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে ন্যস্ত করা হয়।জানতে চাইলে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাইন উদ্দিন বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, পরিদর্শক না পাওয়ার কারণে তখন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এখন অবশ্য পরিদর্শক সহজলভ্য হয়ে গেছে বলে তিনি স্বীকার করেন।বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাল সংগ্রহে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালা ২০১৭ মানা হয়নি। ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম করে চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।নিম্নমানের চাল বের হচ্ছেইএদিকে গত ২৬ আগস্ট গোপন সংবাদের ভিত্তিতে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাবরিনা শারমিন স্থানীয় খাদ্যগুদামে অভিযান চালিয়ে খাওয়ার অনুপযোগী চালের সন্ধান পান। এরপর তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। এ ছাড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকেও পৃথক কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটি মঙ্গলবার পর্যন্ত দুর্গাপুর খাদ্যগুদাম থেকে মোট ৮০ মেট্রিক টন খাওয়ার অনুপযোগী চাল বের করেছে। কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে দুর্গাপুর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে।মঙ্গলবার দুপুরের পরে দুর্গাপুরে খাদ্যগুদামে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদাম থেকে ২০০ মেট্রিক টন চাল দুর্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। তার মধ্যে ইউএনওর আপত্তি ছিল ১৩২ বস্তা চাল নিয়ে। সেই চাল ভবানীগঞ্জে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আর কোনো নিম্নমানের চাল এই গুদামে নেই।
সেখান থেকে ইউএনও কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত ওই গুদাম থেকে মোট ৮০ মেট্রিক টন খাওয়ার অনুপযোগী চাল বের করা হয়েছে। মঙ্গলবারও ২০ মেট্রিক টন চাল বের করা হয়েছে। এখনো বাছাই চলছে। সেখানে রফিকুল ইসলামকে ডাকা হলে সবার সামনে তিনি ৮০ মেট্রিক টন খাওয়ার অনুপযোগী চালের কথা স্বীকার করেন।এদিকে নিম্নমানের চাল ধরা পড়ার পর খাদ্যগুদাম থেকে কৌশলে অনেক চাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গত ২৮ আগস্ট দুর্গাপুর খাদ্যগুদামের নৈশপ্রহরীর শাজাহানের বাড়িতে সরকারি সিল মারা বস্তায় সাত মেট্রিক টন চাল ঢোকানো হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে তা আবার তাড়াতাড়ি করে সরিয়ে ফেলা হয়। এ ব্যাপারে নৈশপ্রহরী শাজাহানকে ফোন করা হলে তিনি দাবি করেন, বাড়িতে চাল নেওয়ার বিষয়টি তিনি অবগত নন।
খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, শাজাহান আলীকে তিনি চেনেন না। তাঁর বাড়িতে চাল যাওয়ার বিষয়টি তিনি অবগত নন। অথচ ঘটনার দিন ইউএনওর কার্যালয়ে অনেক মানুষে সামনে তিনি স্বীকার করেছেন যে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে এই চাল দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে বলেছেন। এ–সংক্রান্ত ভিডিও পাওয়া গেছে।একটি সূত্রের মাধ্যমে খবর পেয়ে নিম্নমানের চাল জব্দ করা হয় বলে জানান দুর্গাপুরের ইউএনও সাবরিনা শারমিন। তিনি বলেন, ‘আমি দুই দিন আকস্মিক খাদ্যগুদাম পরিদর্শন করি। কিন্তু চালগুলো অন্য জায়গায় রাখায় শনাক্ত করতে ব্যর্থ হই। ২৬ আগস্ট আমি আবারও আকস্মিক পরিদর্শনে যাই এবং নিম্নমানের চাল জব্দ করি। তদন্ত কমিটি এর সত্যতা পায়। এ পর্যন্ত ৮০ মেট্রিক টন নিম্নমানের চাল শনাক্ত করে খাদ্য বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই চালের সরকারি মূল্য প্রায় ৪০ লাখ টাকা।’