সোহেল রানা,রাজশাহী,প্রতিনিধি:
রাজশাহী নগরের তালাইমারি মোড়। জুলাই আন্দোলনের গর্জনমুখর দিনগুলোতে যে স্থান ছিল রাজশাহীর তরুণদের শক্ত ঘাঁটি, সেই স্থানেই দাঁড়িয়ে এখন নতুন এক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু-আরডিএ কমপ্লেক্স। প্রায় ৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই আধুনিক স্থাপনা নিয়ে সিদ্ধান্ত বদলের দাবি তুলেছেন আন্দোলনে যুক্ত তরুণ- ‘জুলাই যোদ্ধারা’। তাদের দাবি, বাণিজ্যিক ভাড়ায় স্কুল না চালিয়ে ভবনটিকে করতে হবে “জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালা”।
বঙ্গবন্ধু স্কয়ার থেকে ‘আরডিএ কমপ্লেক্স’-বিতর্কের সূচনা
এক একর জমিতে প্রায় ৬০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবনটির নির্মাণ শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু স্কয়ার’ নামে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নাম বদলে হয় ‘আরডিএ কমপ্লেক্স’। স্থাপত্য নকশা তৈরি করেন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত স্থপতি মো. রফিক আজম ও তার প্রতিষ্ঠান ‘সাতত্য’। আলো-বাতাস ও চলমান মানুষের জীবনধারাকে কেন্দ্র করে তৈরি এ স্থাপনাটিকে তিনি বলেছিলেন “অচিন পাখির মতো আলো-হাওয়ার প্রবাহমান স্থাপত্য”।
২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে প্রকল্পটি পিছিয়ে যায়। অবশেষে আরডিএ পূর্ণাঙ্গ বোর্ড সিদ্ধান্তে কমপ্লেক্সটি ভাড়ায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উন্মুক্ত দরপত্রে সর্বোচ্চ দরদাতা দেবাশীষ প্রামানিক ২৯ লাখ টাকা জামানত ও মাসিক ৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকায় ১০ বছরের জন্য কমপ্লেক্সটি লিজ নেন। পরে তিনি এটি ভাড়া দেন ক্যামব্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলকে। স্কুলটির সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, শতাধিক শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়েছে।
“এই জায়গা আন্দোলনের স্মৃতি-এখানে স্কুল কেন?”
রোববার দুপুরে আরডিএ ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে ‘৩৬ জুলাই ছাত্র পরিষদ’। তাদের দাবি-ভবনের বর্তমান লিজ বাতিল করে সেখানে স্থাপন করতে হবে শহীদদের স্মৃতিবাহী সংগ্রহশালা।
রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম মুখ মাহমুদুল হাসান মাসুম বলেন-
“তালাইমারিই ছিল আমাদের আন্দোলনের কেন্দ্র। যেখানে আমরা শহীদদের স্মৃতিতে দিনরাত কাটিয়েছি। সেখানে বাণিজ্যিক স্কুল বসানো আমাদের আন্দোলনকে অবজ্ঞা করার শামিল। আরডিএ আমাদের আগে আশ্বাস দিয়েছিল সংগ্রহশালা হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেওয়ার আগেই ভাড়া দিয়ে দিলো।”
আরডিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা শেষে তারা জানান, দুই দিনের মধ্যে বোর্ডসভায় বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। জুলাই যোদ্ধারা আগামী বৃহস্পতিবার এসে সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছেন।
“এই কমপ্লেক্স হবে জ্ঞানের উন্মুক্ত কেন্দ্র, ক্ষমতার প্রতীক নয়”
৩৬ জুলাই ছাত্র পরিষদের সভাপতি আবদুল মমিন বলেন-
“এই প্রতিষ্ঠান ছাত্রদের স্মৃতি আর সংগ্রামের প্রতীক। কেউ একা ভাড়া নিয়ে চালাবে-এটা গ্রহণযোগ্য নয়। পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে কাকে ইজারা দেওয়া হবে। ভবনটিকে আমরা জ্ঞানের মুক্ত কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শেখে-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।”
আরডিএর অবস্থান-“পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে”
আরডিএ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক বলেন-
“উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ দরদাতা ভবনটি পেয়েছেন। তিনি কাকে ভাড়া দেবেন সে বিষয়ে আমাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ নেই, তবে ভবনে অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান চললে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বর্তমানে যে বিরোধিতা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা বিশ্লেষণ করছি। প্রয়োজনে বোর্ড সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে।”
ক্ষতির আশঙ্কায় স্কুল কর্তৃপক্ষ
অন্যদিকে ক্যামব্রিয়ান স্কুলের সিইও রমেনটু চাকমা জানান-
“আমরা নিয়ম মেনে এসেছি, পুরো প্রস্তুতি শেষ। শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এখন যদি আমাদের ফিরতে বলা হয়, আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ব।”
স্থাপত্যের আত্মায় সংগ্রামের ইতিহাস-জুলাই যোদ্ধাদের প্রত্যাশা
স্থাপনা নকশার পেছনের দর্শনও যেন নতুন করে আলোচনায় এসেছে। স্থপতি রফিক আজমের তৈরি এই স্থাপত্য ‘উদযাপনবোধ’ ও ‘জনসম্পৃক্ততার’ প্রতীক-যেখানে আলো-বাতাসের প্রবাহ আর মানুষের চলাচলের সঙ্গে মিলেমিশে উঠে আসবে ইতিহাস।
জুলাই যোদ্ধাদের মতে, এই দর্শনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানানসই হচ্ছে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ করা।
ভবিষ্যৎ কী? সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রাজশাহী
বর্তমানে কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকে পাশাপাশি ঝুলছে দুটি ব্যানার-একদিকে ক্যামব্রিয়ান স্কুল, অন্যদিকে ৩৬ জুলাই ছাত্র পরিষদের প্রতিবাদ ব্যানার। দেয়ালে টাঙানো আছে শহীদদের ছবি। দুই পক্ষের অবস্থান কঠোর হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
এখন সবার দৃষ্টি আরডিএ বোর্ডসভার দিকে।
ভবনটি কি থেকে যাবে বেসরকারি স্কুল হিসেবে?
না কি এর নামের সঙ্গে যোগ হবে নতুন পরিচয়-জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালা?