
সোহেল রানা,রাজশাহী,প্রতিনিধি:
রাজশাহী মহানগরীর এক শান্তিপূর্ণ পাড়া ডাবতলা বৃহস্পতিবার বিকেলে পরিণত হয় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের স্থানে। মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের ছেলে তাওসিফ রহমান সুমন (২০) নিজ বাসায় খুন হয়েছেন। এ সময় বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসী গুরুতর আহত হন। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে হামলাকারী যুবক লিমন মিয়া, যিনি ‘বিচারকের ভাই’ পরিচয়ে বাসায় প্রবেশ করেছিলেন।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বিকেল আড়াইটার দিকে রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানার ডাবতলা এলাকার স্পার্ক ভিউ ভবনের তৃতীয় তলায় বিচারকের ভাড়া বাসায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। ভবনের দারোয়ান মেসের আলী জানান, “একজন যুবক এসে বলল, আমি বিচারকের ভাই। নাম লিখল লিমন, একটা নম্বরও দিল। আমি চিনতাম না, তাই ঢুকতে দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরই বাসা থেকে চিৎকার শুনি।”
পুলিশ জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি গাইবান্ধার বাসিন্দা লিমন মিয়া (৩৫)। তিনি ফ্ল্যাটে ঢুকেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে অতর্কিত হামলা চালান। ঘটনাস্থলেই নিহত হন তাওসিফ রহমান। তাঁর মা লুসী হামলাকারীকে ঠেকাতে গেলে গুরুতর জখম হন।
প্রতিরোধের সময় লিমন নিজেও আহত হন। প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনে পুলিশে খবর দেন। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের দল দ্রুত গিয়ে লিমনকে আটক করে এবং আহতদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ভর্তি করে।তাওসিফের মরদেহ রামেক মর্গে পাঠানো হয়। তাঁর মা তাসমিন নাহারের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয় এবং তিনি এখন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। লিমনও পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বিচারক আব্দুর রহমান ঘটনার সময় রাজশাহীতে ছিলেন না; তিনি জামালপুরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন এবং খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছান।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনার সঙ্গে একটি পুরনো পারিবারিক বিরোধ জড়িত থাকতে পারে। গত ৬ নভেম্বর বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসী সিলেটের জালালাবাদ থানায় লিমন মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগে একটি জিডি (জেনারেল ডায়েরি) করেন। তিনি উল্লেখ করেন, “কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য হওয়ায় লিমন মিয়া পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে।” এই জিডিকেই এখন তদন্তের মূল সূত্র হিসেবে বিবেচনা করছে পুলিশ।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, “প্রাথমিকভাবে পারিবারিক শত্রুতা থেকেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করছি। তবে উদ্দেশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত হতে বিস্তারিত জেরা চলছে।”
উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) গাজিউর রহমান জানান, “আটক লিমনের কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য নেওয়া হয়েছে। ফরেনসিক ও সাইবার টিম যৌথভাবে তদন্ত করছে।”
তিনি জানান, রাজপাড়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। ক্রাইম সিন ইউনিট ও ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছে। সিসিটিভি ফুটেজ ও মোবাইল ট্র্যাকিং চলছে। সিলেটের জিডির পূর্ণ কপি সংগ্রহ করছে পুলিশ। ডিবি ও সাইবার ইউনিট তদন্তে যুক্ত হয়েছে।
এই নৃশংস ঘটনাটি দেশজুড়ে বিচারক ও তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। প্রধান বিচারপতি শোক প্রকাশ করে বলেছেন, “এমন ঘটনা বিচার ব্যবস্থার ওপর আঘাত। সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।”
রাজশাহী নগরে শোকের আবহ নেমে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বিচারকের বাসার সামনে ভিড় করে শোক প্রকাশ করেছেন। আইনজীবী ও বিচারকরা বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। ঘটনাটি বিচার বিভাগের নিরাপত্তা কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
রাজশাহীর এই হত্যাকাণ্ড শুধু এক পরিবারের জন্য নয়, বরং পুরো বিচার প্রশাসনের জন্য এক গভীর আঘাত। তাওসিফ রহমানের অকাল মৃত্যু এবং তাসমিন নাহারের অসহ্য যন্ত্রণা আজ ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে নতুন করে সামনে এনেছে। “এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর যেন না ঘটে” -এই প্রত্যাশাই এখন রাজশাহীসহ সারাদেশের মানুষের।
Leave a Reply